ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। ইসলাম মানবতার মুক্তির ধর্ম। প্রতিটা মানুষের জীবনের সার্বিক কল্যাণ সাধনই ইসলাম ধর্মের একমাত্র প্রয়াস। মানুষের জীবনকে সুরক্ষা দেবার জন্য যেমন এতে রয়েছে শরীয়তের বিধি বিধান, তেমনি মানুষ যেন শরীয়তের বিধিবিধান অনায়াসেই পালন করতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও সৃষ্টি করে দেয় ইসলাম।
সমাজকে অনাচার থেকে সুরক্ষার জন্য ইসলামে রয়েছে কঠীন কিছু শাস্তির বিধান। এ ব্যাপারে ইসলাম একেবারেই আপোসহীন। ইসলাম শুধু মাত্র সে অপরাধের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদন্ড দিয়েছে, যে অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি মৃতুদন্ড ছাড়া অন্য কিছু হলে সমাজে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে।
মৃত্যুদণ্ড আসলে যুগে যুগেই ছিল। কিন্তু এর জন্য কোন সুনির্দিষ্ট আইন ছিলনা। ছিলনা কোন মুলনীতি। যুগে যুগে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই তাদের ইচ্ছানুযায়ী কী ধরণের অপরাধের জন্য কী শাস্তি কার্যকর হবে, তা নির্ধারন করতো। দেখা গিয়েছে, কোন এক শাসনামলে যিনার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড, হোক সে বিবাহিত অথবা অবিবাহিত, অপরদিকে, আরেক শাসনামলে, এটা কোন অপরাধের মধ্যেই পরিগণিত হয়নি।
এতো গেল অপরাধ বিশেষে শাস্তির কথা। এরপর আসা যাক শাস্তি প্রয়োগের প্রক্রিয়ার ব্যাপারে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেয়া হয়েছে অপরাধীকে। কখনও গলা কেটে, কখনও করাত দিয়ে শরীর দুভাগ করে, কখনও গরম তামার পাত্রে পুড়িয়ে, কখনও কারেন্ট শক দিয়ে। এভাবে আরও অনেক উপায় আছে যা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অপরাধীর শাস্তি বিধানে ব্যক্তির ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রাধান্য পেয়েছে।
কিন্তু ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যেখানে অপরাধীর শাস্তি বিধান কিভাবে হবে, তা ধ্রুব। ১৪০০ বছর থেকেই এটা অপরিবর্তনীয়। কারো ক্ষমতা নেই তা পরিবর্তন করার। এমনকি শাস্তি বিধান করার ক্ষেত্রে কারো ব্যক্তিগত আক্রোশ ও এখানে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনা। বরঞ্চ, অপরাধীর শাস্তি বিধান হয়ে গেলে, সেই অপরাধীকে সম্মান পর্যন্ত দেয়া হয়। কোন অপরাধীর প্রতি আক্রোশবশত শরীয়তের বাহিরে ভিন্ন কোন উপায়ে শাস্তি কার্যকর করার ও কোন সুযোগ নেই।
একবার এক বিবাহিত মহিলার যিনার শাস্তি কার্যকর করার সময় যখন পাথর নিক্ষেপের কারণে সেই মহিলার শরীর হতে কিছু রক্ত ছিটে এসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর গায়ে এসে লাগে, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে সেই মহিলার ব্যাপারে কটু কথা বলেছিলেন। কিন্তু এটা শুনে রাসুল (সাঃ) খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) কে নিষেধ করলেন। এবং মহিলার ব্যাপারে প্রশংসা করে বললেন যে, সে মহিলার তাওবা যদি অমুক গোত্রের মানুষের মাঝে ভাগ করে দেয়া হতো, তাহলে তা যথেষ্ট হতো। এছাড়াও ইসলামে আগুন দিয়ে শাস্তি, চেহারা বা শরীর বিকৃত করে শাস্তি এমনকি মৃত ব্যক্তির শরীর বিকৃত করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
যাই হোক, যুগে যুগে মানুষের তৈরী যে সমস্ত শাস্তির উপকরণ দ্বারা মানুষকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা বোঝানোর জন্যই একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি ফিরাউনের শাসনামলের।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণনা এসেছে। রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম হতে তিনি শুনেছেন। এ হাদীসের সনদ হাসান।
মেরাজের
রাত্রে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছিল তখন তিনি খুব সুন্দর একটি সুগন্ধ পান। খুবই মোহণীয় সুগন্ধ ছিল
সেটা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম জিব্রাইলকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস
করেন। জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সুগন্ধ হচ্ছে সেই মহিলার এবং তার
সন্তানদের, যে ফেরাউন কন্যার কেশ বানানোর কাজ করতো অর্থাৎ ফেরাউন কন্যার
হেয়ার ড্রেসার ছিল। রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম বললেন, তার ব্যাপারটা আসলে
কি? জিব্রাইল আঃ বললেন, একদিন সে মহিলা ফেরাউন কন্যার চুল আঁচড়াচ্ছিল।
হঠাৎ তার হাত থেকে লোহার চিরুনি অকস্মাৎ নিচে পড়ে যায়। সে বলে ওঠে
বিসমিল্লাহ। ফেরাউন কন্যা বলে “আমার বাবা”? উত্তরে সেই মহিলা বলে, “না,
আমার রব এবং তোমার বাবার রব, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ।” ফেরাউন কন্যা বলল, “ঠিক
আছে, আমি আমার বাবাকে জানাবো?” মহিলা বলল, হ্যাঁ। অতঃপর কথাটি ফেরাউনের
কানে গেল। ফেরাউন মহিলাটিকে ডেকে পাঠালো। দরবারে সবার সামনে জিজ্ঞেস করল, ”
হে অমুক! আমি ছাড়া তোমার ভিন্ন কোনো রব আছে কি?”
মহিলা উত্তর দিল,
হ্যাঁ, আমার রব এবং আপনার রব তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। এটা শুনে ফেরাউন তার
সভাসদদের একজনকে তামার তৈরি গরু নিয়ে আসতে বলল। সেই তামার তৈরি গরুকে আগুন
দিয়ে গরম করে তার ভেতর সেই মহিলা এবং তার সমস্ত সন্তানদেরকে ফেলার আদেশ
দিল। নারীটি বলল, আমার একটি অনুরোধ ছিল। ফেরাউন জিজ্ঞেস করল, কি সেই
অনুরোধ। মহিলা বলল, মৃত্যুর পর আমার এবং আমার সন্তানের হাড্ডিগুলো দয়া করে
একটি কাপড়ে নিয়ে একই জায়গায় দাফন করা হোক। ফেরাউন বলল, তোমার অনুরোধ
আমি রাখবো। এরপর তার সন্তানদেরকে বাসা থেকে ধরে আনা হলো। একটার পর একটা
সন্তানকে গরুর মত দেখতে তামার পাত্রে ফেলে দিয়ে পোড়ানো হলো। তার সর্ব
কনিষ্ঠ সন্তান ছিল দুগ্ধপোষ্য। যখন এই দুগ্ধপোষ্য সন্তান সহ সেই মহিলাকে
ফেলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সেই মহিলার অন্তরটা একটু দুর্বল হয়ে
ফেরাউনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে আশ্চর্যজনকভাবে সেই
দুগ্ধপোষ্য সন্তানের মুখ থেকে কথা বের হল। বাচ্চাটি বলল, “ও আমার মা! আপনি
এগিয়ে যান কারণ পরকালের শাস্তির চেয়ে দুনিয়ার শাস্তি অত্যন্ত সহজ।” এ
কথা শোনার পর মহিলা সামনে এগিয়ে গেলেন।
ইতিহাসে মধ্যযুগীয় বর্বর শাস্তি হিসেবে ভয়াবহ যে ইন্সট্রুমেন্ট এর নাম শোনা যায় তার মাঝে অন্যতম হলো ব্রাজেন বুল। ব্রাজেন বুল হল, তামা দিয়ে তৈরি গরুর আকৃতির একটি বড় পাত্র।

এই পাত্রের ভিতর জীবন্ত মানুষ ঢুকিয়ে পাত্রের নিচে আগুন জ্বালিয়ে পাত্রটি গরম করা হয়। তামার পাত্র হওয়ার কারণে খুব তাড়াতাড়ি তাপমাত্রা সঞ্চালন হয়ে ভিতরের মানুষটিকে একদম পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলা হয়। অবশেষে শুধুমাত্র তারা হাড্ডি এবং মাংসের কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকে। ব্রাজেন বুলের এই পাত্রের মুখে একটা পাইপের মতো অংশ লাগানো থাকে যার মধ্য দিয়ে ভিতরে থাকা মানুষের আর্তচিৎকারের আওয়াজ বের হয়ে আসে। আওয়াজটা শুনে অনেকটা গরুর ডাকের মতো মনে হয়। বিশাল জনসম্মুখে এই শাস্তি দেয়া হতো। ভিতরে থাকা মানুষটির আর্তচিৎকার যখন বাহিরে গরুর ডাকের মতো বের হয়ে আসতো, সেটা শুনে সবাই হাততালি দিয়ে উল্লাস করতো। চিন্তা করে দেখেছেন কি ভয়াবহ! ফেরাউনের এই ঘটনাটা এবং ব্রাজেন বুলের যে ইতিহাস, তা বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি ধারণা করা যায়, যে এই দুটোই সমসাময়িক।
একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, সেই মহিলাটি কেন তার সন্তানদের অবশিষ্টাংশ একটি কাপড়ে নিয়ে এক জায়গায় দাফন করতে বলল। বিভিন্ন ইসরাইলিয়াত বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহিলাটি ফেরাউন কন্যার কেশ বিন্যাসে এতটাই ব্যস্ত থাকত যে, সে তার সন্তানদের সঙ্গে খুবই কম সময় দিতে পারত। সারাদিন দরবারে খেটে এরপর রাতে তার সন্তানদের কাছে যেত এবং তাদের খাবার খাওয়াতো। যেহেতু সে সন্তানদের দুনিয়াতে সময় দিতে পারেনি তাই সে চেয়েছিল যেন হাশরের ময়দানে তার সন্তানরা তার সাথেই পুনরুত্থিত হয় এবং তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান যেন তার কোলেই থাকে।
এক সাধারন দাসি শ্রেণীর মহিলার ঈমানের জাজবা যে এত চমৎকার হতে পারে তা আসলেই ভাবা যায় না। হয়তো সে সময়ের মানুষেরা তার ঈমানের জন্য এই ত্যাগের কথা জানতে পারেনি। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা চেয়েছেন, তাঁর এই ঘটনাটা শেষ উম্মত জানবে। এবং কেয়ামত পর্যন্ত এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা হবে। তাইতো তিনি তার প্রিয় নবীকে জিব্রাইলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন।
বিভিন্ন ইসরাইলিয়াত বর্ণনায় আরো পাওয়া যায় যে, এই মহিলার ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করার পরই বিবি আসিয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরাউনের সামনে তার ঈমানকে নির্ভীক চিত্তে প্রকাশ করেন।
আল্লাহ সব থেকে ভালো জানেন।