সূত্রঃ উম্মে খালেদ
অক্টোবর শুরু হলেই পশ্চিমা দেশগুলোর উঠোনগুলোতে হ্যালোইনের আয়োজন দেখা যায়। দোকানগুলোয় পসরা বসে হ্যালোউইন থিমের পোশাকের। বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নয়। যাই হোক, এগুলো আমার বাচ্চাদের নজরে পড়ে। মাসের শুরুতে এক ছুটির দিনে বাচ্চারা দাদা বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। সেখানে পাশের বাড়ির লোকজনেরা হ্যালোইনের বেশ বড় রকমের আয়োজন করছিল। সে এক বিশাল ব্যাপার! এক ডাইনী ঢাউস একটা জালার ভিতর ঐন্দ্রজালিক সুধা জ্বাল দিচ্ছে, আর তা থেকে সত্যি সত্যি বাবল বের হচ্ছে। কোচের ভিতর কঙ্কাল আরোহী, কুমড়া কেটে বানানো লণ্ঠন, উড়ন্ত ভূত – কী ছিল না সেখানে?
আমার বাচ্চারা এই চোখ ধাঁধানো আয়োজন সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো। বাসায় ফিরে বাচ্চারা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে সেটা বলছিল। ওরা ছোট মানুষ, স্বাভাবিকভাবেই এসব দেখে ওদের মজা লাগার কথা। কিন্তু ওদের কণ্ঠের উত্তেজনা আমাকে চিন্তিত করে তুললো। তাই বাচ্চাদের নিয়ে বসলাম।ওদের সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছিলাম সেদিন, তবে এমনভাবে বুঝিয়ে বলেছিলাম যেন হ্যালোইন নিয়ে ওদের ভিতর আর কোন আগ্রহ না জন্মায়। যখন বাচ্চাদের অমুসলিমদের এই কাজ সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলাম, একদম যা সত্য তাই বলেছি। একটুও বানিয়ে বলিনি কিংবা এটা ভাবিনি যে ‘এরা তো ছোট মানুষ, কিছু একটা বুঝিয়ে শান্ত করি।
“আচ্ছা তোমরা কি জানো কিভাবে এই হ্যালোইনটা আসলো? এটাকে বলা হতো ‘অল হ্যালোস ঈভ’। এই জিনিস বানিয়েছিলো মূর্তিপূজক আর মুশরিকরা।” কুরাইশের গল্প শুনে শুনে মুশরিকদের সম্পর্কে বাচ্চাদের একটা আইডিয়া ছিলো। আমি ওদের সাথে মুশরিক, নাস্তিক, খ্রিস্টান, ইয়াহুদী ইত্যাদির পার্থক্য আলোচনা করেছি, আর এটাও বুঝিয়ে বলেছিলাম কেন ইসলাম এদের সবার থেকে আলাদা।
“এই মুশরিকরা ভূত-প্রেতের মতো জিনিসকে খুব ভয় পেত। মনে করতো, বুঝি এই উঠে আসলো মরা মানুষটা। একদম অযৌক্তিক ভীতি, তাই না? খুবই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলো ওরা। ডাইনী, বাদুর, কঙ্কাল, ভূত – এসবের ভয়ে ঘুম হারাম হয়ে যেত ওদের। তাই ওরা করলো কী, একটা পুরো উৎসব বানিয়ে ফেললো ভুতুড়ে আত্মাদের জন্য – যেন সেসব অশুভ জিনিস সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এখন এই হ্যালোউইনটা একটা ছুটির দিন হয়ে গেছে। এই দিনটা খ্রিস্টান ইহুদী সহ অন্যান্য অমুসলিমরা কিভাবে পালন করে জানো? ওরা এমন জামা পরে সাজে যেন ওদের ভয়ংকর দেখায়। এরপর মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে ক্যান্ডি আদায় করে।কারও দরজায় গিয়ে ওরা নক করে বলে ‘ট্রিক অর ট্রিট!’, মানে হলো ‘হয় তুমি আমাদেরকে ক্যান্ডি দাও, নইলে কিন্তু আমরা ভূত সেজে এসেছি। দেখো কী করি।’
”আমার চার বছর বয়সী বাচ্চাটা এটা শুনে ক্ষেপে গেল। “এটা তো ঠিক না। কেউ কি এভাবে বলতে পারে?” আসলে বাচ্চাদের ন্যায়-অন্যায়ের বোধটা বেশ শক্ত। এমন উল্টোপাল্টা ক্যান্ডির দাবি করে হুমকি দেয়া জিনিসটা ও ভালোভাবে নিলো না।“একদম ঠিক বলেছ”, আমি বললাম, “এটা এক ধরণের জোর করা হচ্ছে।”এবারে মুখ খুললো আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাটা, “আর…আর এত ক্যান্ডি খেলে তো ওদের দাঁত নষ্ট হয়ে যাবে।“আমি হাসি চেপে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ও হলো এই বাড়ির পিঁপড়া, মিষ্টির ভক্ত।সাত বছরের বাচ্চাটা বললো, “ওরা এসবকে এত ভয় পায় কেন? মরা মানুষকে কেন ভয় পায়? কিয়ামতের দিনের আগে ওরা তো কেউ আর ফিরে আসবে না।“ আমার বাচ্চারা কিয়ামতের দিনের কথা খুব স্পষ্টভাবে জানে। কুরআন মাজীদের ৩০ পারায় বারবার কিয়ামতের কথা এসেছে, স্বভাবতই এ নিয়ে ওদের সাথে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়েছে।“ঠিক”, আমি বললাম, “আর যেহেতু আমরা মুসলিম, আমরা জানিই যে আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কিছুকে ভয় পেতে হয় না। আমরা এসব ডাইনী, কঙ্কাল, ভূত-প্রেতে ভয় করি না। এই আজগুবি জিনিসগুলো ওরা বানিয়েছে। এগুলো সত্যিকারে কিছু না। কিন্তু শয়তান মানুষকে ভয় দেখাতে পছন্দ করে, তাই ওরা ওকে মেনে চলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে।
আর দেখো, আমাদের মুসলমানদের কিন্তু দারুণ দারুণ উৎসব আছে। বলো তো কী কী?”“ঈদ উল আযহা আর ঈদ উল ফিতর”, সমস্বরে উত্তর দিলো ওরা। “হ্যাঁ, আর এগুলো এসেছে সত্যি ঘটনা আর আল্লাহ তাআলার প্রেরিত ওহীর মাধ্যমে। কোন বানানো ইলাহের উপাসকের কল্পনা থেকে আসে নি। আমরা সেই দিনগুলিই পালন করি, যেগুলো পালন করার যোগ্য। কাল্পনিক কিছুর ভয় থেকে করি না।ইসলাম একদম নিখুঁত, আল্লাহ তাআলা যেভাবে কুরআনে বলেছেন আর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনে যেভাবে দেখিয়ে গেছেন। আচ্ছা বলো তো, একটা কাপ কানায় কানায় পানি দিয়ে ভর্তি – কী হবে যদি তুমি আরেকটু পানি ঢালো?”“পানি উপচে পড়ে যাবে।““একদম ঠিক। এখন যদি আমরা ইসলামে নতুন কিছু যোগ করতে যাই, তাহলে আমাদের কাছ থেকেও কিছু একটা বের হয়ে যাবে। ইসলামে নেই এমন কিছু পালন করতে গিয়ে তো আমরা আমাদের যা ছিলো, তাও নষ্ট করে ফেলছি। এজন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের যা দিয়েছেন তার বাইরে আমরা আর কিছু পালন করবো না।“বাচ্চারা খুব সুন্দরভাবেই ব্যাপারটা বুঝলো। এরপর আমাদের আলাপ অন্যান্য বিষয়ে মোড় নিলো। সেদিনের মতো ব্যাপারটার নিষ্পত্তি ঘটলো। কিন্তু সমস্যা হলো পরের সপ্তাহে। বাচ্চারা সেদিন আবারও দাদাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো। ওদের দাদা যখন জিজ্ঞেস করলেন ওরা ‘ট্রিক অর ট্রিট’ করতে কিভাবে বেরুবে, আমার বাচ্চারা সোজা মুখের উপর বলে দিয়েছে “আমরা হ্যালোউইন পালন করি না, এটা প্যাগানদের বানানো উৎসব।“
এর ফলাফল ভালো হলো না। ওদের দাদা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, হ্যালোইন খুবই নির্দোষ একটা উৎসব। এর সাথে ধর্মের কোন সংযোগ নেই। শুধু মজা করা আর ক্যান্ডি খাওয়ার উৎসব এটা, মোটেই ইসলামবিরোধী কিছু না। তাই বাচ্চাদের নিয়ে আমার আবারও বসতে হলো। এবারের আলোচনার টপিক ছিলো আত্মীয়দের ব্যাপারে, যারা মুসলিম কিন্তু আমাদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করে। অথবা যারা নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয়ই দেয় না।
“দেখো, আমরা আমাদের পরিবারের সবাইকে, সব আত্মীয়কে ভালোবাসি। আত্মীয়দেরকে ভালোবাসতে হবে, সম্মান করতে হবে – বিশেষ করে যাঁরা আমাদের থেকে বয়সে বড়।“ আমি কথা শুরু করলাম।আমি খুব সাবধানে ভেবেচিন্তে কথা বলছিলাম। আমি ওদের দাদার কথার সাথে একমত হলে বাচ্চারা বিভ্রান্ত হবে। একমত হওয়ার প্রশ্নও আসে না। কিন্তু বাচ্চাদের চোখে ওদের দাদাকে ছোটও করতে চাচ্ছিলাম না।
“কিন্তু কখনও কখনও আমাদের আত্মীয়রা এমন অনেক কিছু বিশ্বাস করে বসে, যেগুলো ইসলামের অংশই না। অনেক সময় দেখা যাবে উনারা খুব উৎসাহ নিয়ে একটা উৎসব পালন করছেন, ইসলামী উৎসব ভেবে; অথচ এটার কোন ভিত্তিই নেই। আচ্ছা, এমন হলে আমরা কী করি? আমরা উনাদের সাথে তর্কে জড়াই? জড়াই না। যদিও আমরা ছেড়ে দিচ্ছি, আমরা কিন্তু তাদের অনুসরণ করছি না। এখন কী হলো দেখো, আমরা খুব ভালো করেই জানি যে মুসলিমরা হ্যালোউইন পালন করে না, কিন্তু আমরা দাদার মনে কষ্টও দিতে চাই না, তাই না? তাই যদি উনি আবারও হ্যালোউইনের কথা তুলেন, আমরা হুঁ-হাঁ বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাব, তর্ক করবো না। যদিও উনি ভুল করছেন, আমরা ছোটরা ঝগড়া করবো না, ঠিক আছে?”“ঠিক,” বাচ্চারা বললো।“ছোট কেউ উনার ভুল ধরুক, এটা দাদাজানের মনে হয় পছন্দ না”, একজন বলে উঠলো।“হতে পারে,” আমি বললাম, “যেটাই হোক, দাদার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কমবে না। উনার সাথে অমত হলেও আমরা উনাকে শ্রদ্ধা করবো। আর উনি যেসব ভালো কথা বলেন, ঠিক কথা বলেন, সেগুলো শুনবো। কিন্তু যদি উনি ভুল কথা বলেন? মানুষ মাত্রই তো ভুল, তাই না? তাহলেও উনাকে আমরা শ্রদ্ধা করবো, কিন্তু জাস্ট ওই কথাটা শুনবো না।”